প্রকৃতি ও পরিবেশ

বনায়নে প্রজাতি বৈচিত্র প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বন ব্যবস্থাপনা ও বন নীতি
আমাদের পরিবেশকর্মীরা -পরিবেশ দরদীরা প্রায়শই বন সৃজনে বিদেশি প্রজাতির গাছ (alien species) ব্যবহারের জোর বিরোধিতা করে থাকেন । আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে রক্ষার জন্য আন্তরিক অনুরাগের কারনে তারা ভুলে যান পরিবেশ শব্দটির আর্ন্তগত বহুমাত্রিকতা এবং এই বিশেষ সত্যটি যে 'পরিবেশ' কেবলমাত্র কোন কিছুর সাপেক্ষেই হয়ে থাকে, এটা সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন কোন উপাদান নয়। কোন কিছুর শুধু বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হলে চলে না, তা কেবল ঋনাত্তক ধারনারই জন্ম দেয়, বিকল্প পথ বাতলানোর প্রচেষ্টাই যথার্থ সমালোচনা। কিন্তু তেমন দৃষ্টান্ত এদেশে বিরল, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি সমালোচনার পথ থেকে দূরে যেতে যতোটা উদ্ভুদ্ধ করে কাছে যেতে ততখানি করে না। যদিও এমনি করে কখনো দুই-পা এগুনো এক-পা পিছিয়ে, শ্লথ গতিতে হলেও, আমরা সমাজ ও অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রেই এগুচ্ছি সামনের দিকে।
ছোট্ট আমাদের এই দেশে প্রাকৃতিক বন, যখন যে টুকু ছিলো কিংবা আছে, ঐতিহাসিক কাল থেকেই অস্তিত্তের সংকটে। এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বনায়ন উদ্দোগ নেয়া হয়েছিলো উপনিবেশিক কালে, ১৮৭৩ সালে, শুরুই হয়েছিলো বিদেশি প্রজাতির গাছ সেগুন (Tectona grandis) রোপণ করে। বাণিজ্য করাই ছিলো সে-সব বনায়নের উদ্দেশ্য। পরবর্তী দীর্ঘ সময় বন ব্যবস্থাপনার যাবতীয় কার্যক্রম আবর্তিত হয়েছে উপনিবেশিক কালে প্রণীত বন-নীতি ও বন আইনের ছত্র-ছায়ায়, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ক্রমশ সরে এলেও, এদেশের বন ব্যবস্থাপনায় উপনিবেশিক বাণিজ্যিক বনায়নের ভূত আজো রয়ে গেছে। যুগ পাল্টেছে, রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতির নিরিখে প্রয়োজনের তাগিদেই বন ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়েছে জনগনের অংশগ্রহনের বিষয়টি। যদিও এখনো এদেশের অধিকাংশ বনাঞ্চলে ১৯২৭ সনে প্রবর্তিত বন আইনের আওতায় জনগনের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।
রূপকথার গল্পের মতো 'তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে বন' এদেশে নিকট অতীতকালে কখনোই ছিলো না, সময়ের প্রেক্ষিতে আজ আরো নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশে সুন্দরবন , যা তখন 'বাদা' বন হিসাবে অধিক পরিচিতো ছিলো, ধ্বংস করে তালুকদার, বর্গাদার আর ডিহিদারের মতো উচ্চ শ্রেনীর প্রজাস্বত্ব সৃষ্টি করা হয়েছিলো । এখনো বনের পার্শবর্তী ক্ষুদ্র কৃষক অল্প করে বন কেটে কৃষি জমি বাড়ায় আর সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষ্মমতাধর শক্তি নির্বিচারে বন ধ্বংস করে কৃষি অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনে। বর্ণিত এ দুটো বিষয় প্রত্যক্ষ করার জন্য খুব বেশী দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই; ঢাকার পাশে ভাওয়াল জাতীয় উদ্দ্যান এলাকা পরিদর্শন করলেই চলবে। এই বনাঞ্চল রাজধানী ঢাকার খুব কাছে বলে আগ্রাসনের মাত্রা ব্যাপক। একটু দূরের বনে গেলে শিল্পায়নের জন্য আগ্রাসন না দেখতে পেলেও কৃষি আর বসতি স্থাপনের জন্য বনের জমি দখলের ব্যাপকতা শিউরে উঠার মতো। কোথাও কোথাও বিস্তৃর্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল এখন জনবসতিতে পরিনত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় এমন ঘটনা বেশি। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত উপনিবেশিক বন নীতি ও আইন বার কয়েক পাল্টালেও, ভাবতে অবাক লাগে এদেশে এখনো বনাঞ্চল বন্দুক হাতে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। এটা একদিকে যেমন আমাদের বন-নীতি ও আইনের ধূসর দিক, অন্যদিকে তেমনি তা আমাদের সমাজ বাস্তবতা। রাষ্ট্র তার আইন আর নীতি পাল্টিয়ে বন রক্ষার চেষ্টা করলেও সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বন রক্ষার জন্য সচেতন ঐকমত্য গড়ে উঠেনি।
বনের এসব অবৈধ দখলদারদের বন বিভাগ জবরদখলকারী (encoracher) বলে চিহ্নিত করে, বন বিভাগ এ সকল জবর দখলকারীদের উচ্ছেদের জন্য যেমন উদ্দোগ নিয়েছে তেমনি তা করতে না পেরে তাদের পুনঃর্বাসনের জন্যও উদ্দোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে উচ্ছেদ উদ্দোগের চাইতে পুনঃর্বাসন প্রচেষ্টা অধিকতর সফল হয়েছে। আপাত এই সফলতার মধ্যেও পরিবেশকর্মীরা অবশ্যই খুঁজে পাবেন জীব বৈচিত্র ধ্বংসের মতো উদ্বেগজনক বিষয়। ঢাকা,টাংগাইল ও ময়মনসিংহের বনাঞ্চলে প্রাকৃতিক শাল বন ধ্বংস করে জবর দখল করা বনভুমি পুনঃরুদ্ধার করে সেখানে সৃষ্টি করা হয়েছে দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির বন বাগান (plantation); যার সিংহ ভাগই আকাশিয়া/আকাশমনি'র (Accacia auriculiformis) এর দখলে।বাস্তবতা হলো বন বিভাগ বনের জমি পুনঃরুদ্ধার করতে বাধ্য হয়ে দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির বন বাগান সৃজন করলেও এখন এই সকল প্রজাতি ব্যপক মানুষের কাছে এতোটাই লাভজনক মনে হচ্ছে যে ভবিষ্যতে কাষ্ঠল অন্যান্য প্রজাতি ছাপিয়ে এরা আগ্রাসী প্রজাতি (invasive species) হয়ে উঠবে। অবশ্যম্ভাবী এ আগ্রাসন ঠেকানো অত্যন্ত কঠিন, পৃথীবির সকল সফল বিস্তৃত প্রজাতির বিস্তারের ইতিহাসে পর্যালোচনা করলে তাই মনে হবে। প্রজাতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে 'প্রথমে দর্শনধারী তারপরে গুন বিচারি' প্রবাদটি খুব কাজে খাটে না। মানুষের আকাঙ্খা ছাপিয়ে যায় সকল বিবেচনা।এ সম্পর্কে আগ্রহীদের আমি মাইকেল পোলান রচিত The Botany of Desire বইটি পড়তে অনুরোধ করবো।
আশার কথা হলো প্রকৃতি স্থির নয়, সকল নিয়ামকের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে ক্রমশ বিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের অবিবেচনা প্রসূত অনেক কার্যক্রম শুধরাতে প্রকৃতির খুব একটা সময় লাগে না। প্রাসংগিক বিবেচনায় বলা যায় কয়েক বছর আগে এ দেশে সংঘটিত শিশু (Dalbergia sissoo) গাছের মড়কের কথা। তার আগের বছরগুলোতে অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক বিবেচনায় উত্তরাঞ্চলের জেলা সমুহে ব্যপক জনপ্রিয়তা পাওয়া এ প্রজাতিটি রোপনের মাধ্যমে সৃজিত শত শত একর খামারভুমি বনায়ন সেই সময় বিনষ্ট হয়েছে। সেখানকার কৃষক ও নার্সারি উদ্দোক্তাগণ এই প্রজাতিটির প্রতি আর মোটেই আগ্রহী নন।