ন্যাড়া কেন বারবার বেল তলায় যায়? পর্ব-১
ন্যাড়া বেল তলায় যায়, বারবার যায়; পাকা বেলের আশায়,পেয়েও যায় দু-চারটে। পাকা বেল পড়ে গোলার মতো, যেন ন্যাড়ার মাথাটাই টার্গেট, পড়েও,মাথাতেই। তারপর আঘাত-প্রদাহ-স্মৃতিভ্রম-চিকিৎসা-পুনরায় পাকা বেলের আশায় বেল তলায় গমণ।এই চলছে। প্রশ্নটি তাই ঘূরছে মাথায়।
ন্যাড়া'রা একরকম মনুষ্য প্রজাতি,থাকে বাংলাদেশে। ন্যাড়া'দের অনেকেই গায়ে ভালো জামা-কাপড় চড়াতে পারে না, দু-বেলা ঠিক মতো খেতে পারে না; ন্যাড়া'রা গরিব,খুবই গরিব; ন্যাড়া'রা শুনেছে বই-পত্রে ওদের নাকি 'দরিদ্র' বলে ডাকা হয়। কোন এক কবি নাকি দরিদ্রতা নিয়ে গর্ব করে বলেছেন 'হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান কন্টক-মুকুট শোভা'। ন্যাড়া'রা অবশ্য গরিবীর জন্য সম্মানবোধ করে না, আর ঈসা নবীর সাথে গরিবীর কি সম্পর্ক তা তাদের মাথায় ঢুকে না। ওদের দুটো জিনিষ খুব আছে; একটা হচ্ছে পেটের ক্ষিদে আর একটা হচ্ছে লোভ, এক্টু ভালো থাকার লোভ। অবশ্য ন্যাড়াদের দেশে লোভ জিনিষটা সবার মধ্যেই খুব আছে। যারা খেতে পায় না, তারা দু-মুঠো খাবার জন্য লোভ করে; আর যাদের অনেক আছে তারা আরও বেশী পাওয়ার জন্য লোভ করে। যারা অশিক্ষিত তারা শিক্ষা পাওয়ার জন্য লোভ করে, আর যাদের অনেক শিক্ষা আছে তারা শিক্ষা বেচার জন্য লোভ করে।
লোভ করে করে ন্যাড়াদের তাই অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। বিপদ আছে জেনেও নির্বাচনে দেশ তুলে দেয় অযোগ্যদের হাতে। কি করবে, বেচারাদের কি আর এ না করে উপায় আছে? যা সব লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দেয় রাজনীতিক'রা ন্যাড়াদের মুন্ডু ঘুরে যায়! যেমন দেখুন না, আগে দেশের লোকেরা মাছ-ভাত খেতো, ক্রমে দাম বেড়ে গেল, মাছ-ভাত তো দূরের কথা শুধু ভাত'ই জুটছিলো না। গরিব ন্যাড়াদের তখন 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল' সবার জন্য ডাল-ভাতের লোভ দেখালো, ক্ষুধার্ত ন্যাড়া'দের খুব লোভ হলো, ডাল-ভাত খাবার লোভ। এটাকে কি লোভ বলা যায় বলেন? পেটে খানিকটা দানা-পানি না পড়লে চলবে কেমন করে? এছাড়া আরো যা যা বলেছিলো ন্যাড়াদের অত মনেও নেই। তবে লোভ হয়েছিলো খুব! আর তাই ন্যাড়া'রা খুশি মনে ভোট দিয়েছিলো 'ধানের শীষ' মার্কায়, ন্যাড়া'রা জানে তাদের কাছে এই একটা দামী জিনিষ আছে, পাঁচ বছর পর পর যার জন্য একবার করে হলেও তাই ন্যাড়াদের 'দুয়াড়ে হাতির পারা পড়ে'। ন্যাড়াদের দুইটা মার্কা খুব পছন্দ 'নৌকা' আর 'ধানের শীষ'; আবার দুইটা অভাগী মাইয়্যা আছে মার্কার সাথে, নৌকার সাথে 'শ্যাখের বেটি' আর ধানের শীষের সাথে 'জিয়ার বিধবা বউ'; ন্যাড়াদের খুব মায়া ওদের জন্য। তবুও যারা এক্টু বেশী লোভ দেখায় তদেরই ন্যাড়ারা জিতিয়ে দেয় ভোটে। ভোটের সময়টা ন্যাড়াদের খুব ভালো যায়, মাগনা চা-বিড়ি জোটে, কখনও কড়কড়া নোটও! তারপর আবার সেই একই রকম; ক্ষিদে আর লোভ।
সেবার ধানের শীষ'কে জিতিয়ে দিয়ে খুব ভাল কিছু হয়নি; ডাল-ভাতও ঠিকমতো জোটেনি ন্যাড়াদের,চাল-ডাল সবেরই দাম বেড়েছে শুধু। একটা জিনিসের অভাব নেই ওদের। সেটা ঝগড়া; ঘরে বউয়ের সাথে, বাইরে দুই দলের, যদের নাটের গুরু হলো সেই অভাগী দুই বেটি; আহারে কি ঝগড়া দুই বেটির, সামনা-সামনি দেখা হয়না, হলে একটা দারুন চুলা-চুলি দেখতে পারতো ন্যাড়ারা! তবু ন্যাড়ারা দেখেছে, লগি-বৈঠা'র সাথে লাঠি-বাশের লড়াই। ন্যাড়ারা জানে একটা গদিতে বসার জন্যই এসব কিছু। হায়রে গদি! ন্যাড়াদের তখন মনে হচ্ছিলো এই গদিটা দখল করতে পারলে একবার একটা ঝাড়ু দেবার ব্যবস্থা করতো, সব ঝগড়াটে'দের আবর্জনার বাক্সে ফেলার ঝাড়ু। কিন্তু সেটা আর হয়নি!
একদল ফেরেস্তা এসে পড়লো দেশে, এই ফেরেস্তারা দেশেই ছিলো, ন্যাড়া'রা ওদের চিনতো আর্মি নামে; যারা ন্যাড়াদের দেশের ক্ষীর-ননী-ঘি খেয়ে মাসল ফুলিয়ে রাখা কোন-দিন-কাজে-লাগবে এমন দেশ-প্রেমিক-সন্তান, তারা বেড়িয়ে পড়েছিলো তাদের ডেরা থেকে; এসেই বললো আমারা হলাম ফেরেস্তা! তোমাদের আর চিন্তা নেই, আমরা সব আবর্জনা সাফ করে দিচ্ছি। দেশে একটা ফেরেস্তা রাজত্ব কায়েম হলো। সেই ফেরেস্তাদের রাজত্বের সময় ন্যড়াদের দেশটা রাতারাতি অন্যরকম হয়ে গেল; প্রথম কিছুদিন ফেরেস্তারা এমন মারমার-কাটকাট শুরু করে দিলো যে সব সন্ত্রাসী-মাস্তান-কালোবাজারী-বড় বড় ন্যাতা'রা গা ঢাকা দিলো, কেউ কেউ দেশ ছাড়লো। ঝগড়াটে দুই বেটি সহ অনেক বড় ন্যাতারেই জেলে ঢুকালো ফেরেস্তাদের সরকার। অনেক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হলো, দুর্নীতির মামলা। পত্রিকাওয়ালারা তখন 'উইঠ্যা পইড়া লাগ্লো' সব রাজনীতিবিদ'দের দুর্নীতি আর অপকর্মের ফিরিস্তি লিখতে, যেন এতদিন ওরা কুম্ভকর্ণ ছিলো; এই মাত্র ঘুম ভাঙ্গলো! ন্যাড়া'দের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশী, যাদের ওরা 'বুদ্ধিজীবি' মনে করে ধন্য ধন্য কর, তাদের কেউ কেউ সহ ন্যাড়াদের অনেকেই বললো বাহ বেশ, বেশ! ভাবখানা এই যে স্বর্গ এই নামলো বলে ন্যাড়া'দের রাজত্বে।
কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি; ন্যাড়া'দের প্রতিবেলার প্রয়োজন ডাল-ভাতের কথাই ফেরেস্তা'রা বললো না। বলতে পারলো না, দেশে সব কিছুর দাম বেড়ে গেল। ফেরেস্তাদের নেতা তখন আলু খাওয়ার পরামর্শ দিলো ন্যাড়াদের। শুধু পরামর্শ না, দেশ জুড়ে আলুর গুনগান হলো, অনেক রোড-মার্চ হলো, পাচঁ-তারা হোটেলে আলুর রেসিপি উৎসব হলো, জাতি সঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পর্যন্ত নেমে পড়লো ফেরেস্তা'দের সাথে তাল দিয়ে ন্যাড়া'দের আলুর মাহাত্ব্য শেখাতে। অবস্থা সামলাতে ন্যাড়া'দের অনেকেই সেই সময় লাইন দিয়ে সস্তার চাল-ডাল নিয়েছিলো বিডিআর এর ট্রাক আর ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে। বেহেশ্তেও এই রকম লাইন দিয়ে খাবার-দাবার নিতে হবে এই চিন্তায় ন্যাড়া'দের তখন আঊলা-ঝাঊলা অবস্থা। ন্যাড়া'রা দু-বছর পর অনেক বিডিআর-আর্মি মরার পর শুনেছিলো বিডিআরের এই ন্যায্য-মূল্যের কাজে ফেরেস্তারাই নাকি দূর্নীতি করেছিলো। ফেরেস্তারাও দূর্নীতি করে এই কথাটা ন্যাড়া'দের ভীষণ কষ্ট দিয়েছিলো; যদিও ন্যাড়াদের মনে পড়ে গেছিলো এর আগেও একজন আর্মির ব্যারাক থেকে এসে নয় বছর ন্যাড়া'দের দেশ চালিয়েছিলো, সে অবশ্য নিজেরে ফেরেস্তা কয় নাই, কইছিলো 'পল্লীবন্ধু'; আর ন্যাড়া'দের বুদ্ধিজীবিরা তারে কইছিলো 'স্বৈরাচার' আর বিশ্ব-বেহায়া। তার যাওনও আছিলো বিরাট আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস; তারপরই এসেছিলো ন্যড়া'দের এই গণতান্ত্রিক নেতারা, ফেরেস্তারা যাদের দূর্নীতির অভিযোগে জেলে পুড়লো!
দুই বছর অনেক ধানাই-পানাই করলো ফেরেস্তারা; এক ফেরেস্তাতো হ্যালিকপ্টরে চড়ে শহরে শহরে গিয়ে মানুষদের ভালো হয়ে যাবার জন্য ধমক-ধামক দিলো। কিন্তু আচানক কি জানি কি হলো! এই ফেরেশতারাও ভয় পেতে শুরু করলো মানুষদের, সেই মানুষদের যাদের তারা আবর্জনা মনে করে সাফ করতে এসেছিলো। তবুও ফেরেশতারা নির্বাচন করে খাটি মানুষের কাছে ক্ষমতা দিতে চাইলো। ন্যাড়া'দের অস্বীকার করার জো নেই, এই একটা কাজ ফেরেস্তারা খুব ভালো পেরেছে। জাল ভোটের কারবারই ছিলো না। সেইবার ইলেকশনে ন্যাড়া'দের মাগনা চা-বিড়ি তেমন জোটেনি। তবে ন্যাড়া'দের আবারো বেল তলায়ই যেতে হয়েছে। আবার সেই 'নৌকা' আর 'ধানের শীষ'। তবে এইবার 'জিয়ার বিধবা বউটা' তেমন ভালো কিছু 'কইবার পারে নাই', পুত্রশোকে কাতর; হাওয়া-ভবনের হাওয়া তখন আকাশে-বাতাসে । 'শ্যাখের বেটির' কথা ন্যাড়াদের খুব মনে ধরলো। বলে কিনা ক্ষমতায় গেলে ঘরে ঘরে অন্তত একজনের চাকুরী দেয়া হবে, দশ টাকা সের চাল হবে; আর একটা কি জানি বললো 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়বে। এই 'ডিজিটাল' শব্দটা মনে ধরলো খুব ন্যাড়াদের; মানেটা না বুঝলেও ভালো কিছু হবে মনে করলো, ন্যাড়া'রা ডিজিটাল ঘড়ি দেখেছে, সস্তার জিনিষ, সবাই একটা কিনতে পারে; ভাবলো ডিজিটাল বাংলাদেশেও বুঝি সব সস্তা হয়ে যাবে। ন্যাড়াদের আবারো লোভ হলো খিদে মেটানোর লোভ, একটু ভালো থাকার লোভ। ন্যাড়া'রা তাই আবারো বেল তলায় গেল, বিপুল উৎসাহে গেল। নির্বাচন হলো, দেশে গনতন্ত্র এলো। ফেরেস্তারা ফিরে গেলো ঘি-ননীর রাজ্যে। ফেরেস্তাদের নেতারা সব দেশ ছাড়লো।
যে সব নেতারা জেলে গিয়েছিলো, কিংবা দেশ ছেড়েছিলো তাদেরই কেউ কেউ আবার সংসদে গেল। ফেরেস্তাদের বিরুদ্ধে তাদের সে কি আস্ফালন, এই মারে কি সেই মারে! কিন্তু এক সময় সব তর্জন-গর্জন থেমে গেল। ন্যাড়া'দের তখন খুব মনে হলো সেই কথাটা ' সব রসুনের এক গোড়া'। ন্যাড়া'দের উৎসাহ কমতে বেশি দিন লাগলো না। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট কেনার জন্য ট্যাক্স মাপ হয়ে গেল, ন্যাড়া'রা শুনেছে অনেক ফেরেস্তাই নাকি সেই সুযোগে ঢাকায় দু-তিনটে বাড়ী করে ফেলেছে, কিন্তু ন্যাড়াদের ভূমি কর কমলো না। বাজারে এখনো সেই আগুন, সারের দাম কমল, কিন্তু চালের দাম দশ টাকা হল না। বাজার যারা চালায় সেই ব্যবসায়ীদের কিছু করতে পারলো না ন্যাতারা। মন্ত্রিরা বলতে শুরু করলো খাবার কম খেতে, সপ্তাহে একদিন কম বাজারে গেলে নাকি দাম কমে যাবে! ন্যাড়াদের পেটে এখনো খিদে আগের মতোই। গায়ে রাগ-কষ্ট-আর ক্ষোভ আগের চেয়ে বেশী। (চলবে)